আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি #ষষ্ঠ পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

Sidratul Muntaz 


ইয়ামিন ড্রাইভ করছে। তার হাতের বামপাশে বসে আছে উষসী। তার মুখ ভার। শিমলা আন্টি কেন ছেলেকে সঙ্গে পাঠালো এই কারণটা উষসী এখনও বুঝতে পারছে না। ইয়ামিন তার সঙ্গে কোনো প্রকার বাক্যালাপে যাচ্ছে না। ব্যাপারটা উষসীকে পীড়া দিচ্ছে। সুন্দরী মেয়েরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অহংকারী হয়। পৃথিবীর প্রায় সব তরুণ তার জন্য দিওয়ানা হবে এমন একটা ধারণা তাদের মস্তিষ্কে গাঁথানো থাকে। উষসীর এমন ধারণা কখনও ছিল না। তবে এই মুহূর্তে সে যেন নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, ইয়ামিনের উচিৎ তার সঙ্গে কথা বলা। তার দিকে বার বার আড়চোখে তাকানো। সে যথেষ্ট সুন্দরী। তাকিয়ে থাকার মতো সুন্দরী। তবুও মানুষটা তার দিকে তাকাচ্ছে না কেন?


উষসী জানে, এর কারণ আরিশা। ছেলে যদি চরিত্রবান হয় এবং তার যদি প্রেমিকা থাকে তাহলে বিশ্বের সর্বোচ্চ সুন্দরী মেয়ে পাশে বসে থাকলেও সে তাকাবে না। উষসীর ভীষণ জোরে কান্না পাচ্ছে। সে একবার ইয়ামিনের দিকে আড়চোখে তাকালো। সাথে সাথেই তার মনে হলো, কান্নাটা এখন বমির মতো বেরিয়ে আসবে। সবচেয়ে ভালো হতো, উষসী যদি কাঁদতে কাঁদতে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরতে পারতো। তার গালে চু'মু দিয়ে বলতে পারতো," আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং আপনাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। আমার এই অনুভূতির কি কোনো দাম নেই? আপনি সত্যিই আরিশাকে বিয়ে করে ফেলবেন?"


উষসী বিরক্ত হলো নিজের উপর। সে এতো খারাপ মেয়ে হয়ে যাচ্ছে! এতো বাজে চিন্তা করছে! ইয়ামিন বেখেয়ালে উষসীর দিকে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল," আরে, আপনি কাঁদছেন কেন?"


উষসী চোখ গরম করে চাইল। কঠিন গলায় বলল," আমি কাঁদছি এটা আমার ব্যাপার। আপনাকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।"


উষসীর রূঢ় উত্তর শুনে ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল," আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছেন?"


" আপনার উপর আমি কেন রেগে থাকবো? আপনি কে?"


" স্যরি।"


উষসী নিজেও অবাক। সে এসব কি বলছে? সত্যিই বেশি হয়ে যাচ্ছে। আসলে তার মেজাজ ভালো নেই। সে আজ পরীক্ষা মিস করে এখানে এসেছে। কিন্তু ভাবেনি যে তার জন্য এতোবড় সারপ্রাইজ থাকবে। ইয়ামিন আর আরিশা বাল্যকাল থেকে বন্ধু। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকতে পারে এই বিষয়টা কখনও উষসীর মাথায় আসেনি কেন?


উষসীদের এলাকায় প্রবেশ করতেই ইয়ামিন জানতে চাইল," আপনার ফ্রেন্ডের বাসা কোনটা?"


" আমার ফ্রেন্ডের বাসা না৷ এটা আমার নিজের বাসা। এই গলির সামনের গলিতেই।"


" কিন্তু মা যে বলল, আপনি আমাদের বাসার পাশে থাকেন?"


" আগে থাকতাম। এখন বাসা বদলে ফেলেছি।"


" ওহ।"


বাড়ির সামনে এসে উষসী গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সাথে সাথেই সদর দরজা থেকে বের হতে দেখা গেল উষ্ণতাকে। উষসী মনে মনে আয়তুল কুরসি পাঠ করতে লাগল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আপুকে এখনি কেন বাড়ি থেকে বের হতে হবে? উষসী মনে-প্রাণে চাইছে ইয়ামিন যাতে চলে যায়।কিন্তু লোকটা যাচ্ছে না। সে বরং জানালা থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে আছে। তার নজর উষ্ণতার দিকে। উষসী ভয়ে শিটিয়ে গেল। উষ্ণতা তাদের দিকেই আসছে। সে রাগান্বিত স্বরে প্রথমেই ধ'মক দিল," এই তোর সমস্যা কি? আমাদের টেনশন দিয়ে মে'রে ফেলতে চাস? সারাদিন কোথায় ছিলি? পরীক্ষা দিসনি কেন? ফোনও ধরছিস না৷ তোর মোবাইল বের কর। এখনি আমি আছাড় মা'রবো।"


উষসী শুকনো মুখে ইয়ামিনের দিকে তাকালো। তার মান-সম্মান বলে আর কিছু রইল না। উষ্ণতা কড়া দৃষ্টিতে বলল," ওদিকে কি তাকাচ্ছিস? আমি এইদিকে কথা বলছি। আর কে এই বান্দা? তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি? তুই প্রেম করে বেড়াচ্ছিস?"


উষ্ণতার দৃষ্টিতে বিস্ফোরণ। ইয়ামিন গাড়ির দরজা খুলে বের হলো। উষসী মরমে ম'রে যাচ্ছে। ইয়ামিন বিনীত কণ্ঠে বলল," আসসালামু আলাইকুম, আমাকে চিনতে পেরেছেন?"


" আমাদের কি আগে কোথাও দেখা হয়েছে?"


" জ্বী হয়েছে। নয় বছর আগে। আমি আপনার স্টুডেন্ট ছিলাম।"


উষ্ণতা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। এতোবড় কোনো স্টুডেন্ট তার কখনও ছিল বলে তো মনে পড়ছে না। সে বাচ্চাদের পড়াতো। কিন্তু এই ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে তার সমবয়সীই হবে। ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনের রিংটোন শোনা যাচ্ছে। উষ্ণতা মোবাইল রিসিভ করার আগে বলল," জাস্ট ওয়ান মিনিট।"


" শিউর।"


উষ্ণতা একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। উষসী আর ইয়ামিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। উষসীর বলতে মন চাইছে," আপনি এখনও কেন দাঁড়িয়ে আছেন? চলে যাচ্ছেন না কেন?"


কিন্তু মুখে সে বলল," আমার আপু যে আপনার মিস হয়, আমি জানতামই না। কি কাকতালীয় ব্যাপার, তাই না?" 


ইয়ামিন মাথা দুলালো। উষসী এমন ভাব করছে যেন সে ইয়ামিনকে চিনতেও পারেনি। ইয়ামিন তাকে চিনতে পারছে না। কাজেই তারও ইয়ামিনকে আগ বাড়িয়ে চিনতে পারার প্রশ্ন আসে না। উষসী আবার বলল," বাড়িতে চলুন। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।"


" মিস বললে যাবো।"


ইয়ামিনের নির্লিপ্ত উত্তর। উষসী উত্তপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল," কেন? আমার বলা কি বলা নয়? নাকি আমার কথার কোনো দাম নেই?"


উষ্ণতা ফোন রেখেই খুব অস্থির হয়ে উঠল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল," আমাকে এখনি একটা কাজে যেতে হবে। আপনার সাথে অন্য আরেকদিন কথা হবে। উষসী, উনাকে ভেতরে নিয়ে যা।"


ইয়ামিন প্রশ্ন করল," আপনি কখন আসবেন?"


" বলতে পারছি না।"


" আমার সাথে গাড়ি আছে। চলুন আপনাকে পৌঁছে দেই।"


উষসীর মাথা শুধু গরম হচ্ছে। এই লোকের সমস্যা কি? সে মনে মনে বলল," কেন? আপনি কি সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন? আজাইরা!"


উষ্ণতা দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল," আমাকে অনেক দূর যেতে হবে।"


ইয়ামিন নির্দ্বিধায় বলল," আমার কোনো সমস্যা নেই।"


উষ্ণতা একটি অপরিচিত মানুষের গাড়িতে উঠতে অস্বাতিবোধ করছে। তাছাড়া সে এই ছেলের সঙ্গে একা যাবে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। তাই উষ্ণতা বলল," উষু, তুইও চল।"


" আমি গিয়ে কি করবো? তুমি কোথায় যাচ্ছো?"


" হাসপাতালে। আমার একটা বান্ধবীর কথা বলেছিলাম না তোকে? সে মানসিকভাবে অসুস্থ। আমাকে তার মেয়ে ফোন করেছে।"


" ঠিকাছে চলো।"


ইয়ামিন গাড়ির দরজা খুলে দিল। উষ্ণতা সামনে না বসে পেছনে গিয়ে বসল। উষসী বসল ইয়ামিনের পাশে। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর উষসী ক্ষীপ্ত গলায় বলল," আপনি বার বার পেছনে তাকাবেন না প্লিজ। যেকোনো সময় গাড়ি এক্সিডেন্ট করতে পারে। "


এই কথায় উষ্ণতা এবং ইয়ামিন দু'জনই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইয়ামিন থতমত খাওয়া গলায় বলল," স্যরি।"


উষ্ণতার বান্ধবীর নাম সিতারা। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তার স্বামী সাতবছর ধরে নিখোঁজ। প্রবাসে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। যোগাযোগও রাখেনি। প্রেমের বিয়ে তাদের। মেয়েটা স্বামী হারানোর শোকে পাগল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার পাগলামির মাত্রা গুরুতর হয়। হাত-পা কে'টে ফেলে। ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়ে। ভ'য়াবহ অবস্থা। শীতকালে তার পাগলামির প্রকোপ বেড়ে যায়। উষ্ণতা আর ইয়ামিনকে একসঙ্গে দেখেই সিতারা বলল," এই ছেলেটা কে? তোর নতুন বর নাকি? আগেরটাকে ছেড়ে দিয়েছিস?"


বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল। উষ্ণতা অপ্রস্তুত হয়ে বলল," উনি আমার বর না।"


সিতারার মেয়ে সিমি কথা বলল," মায়ের মাথা একদম ঠিক নেই আন্টি। আপনি মায়ের কথায় কিছু মনে করবেন না।"


সিতারা রেগে উঠল। চোখ পাকিয়ে বলল," কে বলেছে মাথা ঠিক নেই? আমার মাথা একদম ঠিক আছে। উষ্ণ, তুই এদিকে আয়। আমার পাশে বোস। তোর সঙ্গে গোপন কথা আছে।"


উষ্ণতা সিতারার পাশে বসল। সিতারার জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছে। সম্ভবত আগামী একমাস সে এখানেই থাকবে। তার চেহারায় র'ক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাচ্ছে। আবারও কোনো কান্ড ঘটিয়েছে নিশ্চয়ই। সিতারা খুব গোপন খবরের মতো ফিসফিস করে বলতে লাগল," গতরাতে রিত্তিক রোশান আমাকে ফোন করেছিল।"


এমন উদ্ভট কথা শুনে উষ্ণতা বিব্রত হলো। ইয়ামিন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। তার খুব মায়া লাগছে ভদ্রমহিলার জন্য। উষ্ণতা হতাশ কণ্ঠে বলল,


" ও তাই নাকি?"


" হ্যাঁ। ফোন করে কি বলেছে জানিস?"


" কি বলেছে?"


" আমাকে বিয়ে করতে চায়।"


" ও আচ্ছা। তুই কি ভাবলি? বিয়ে করবি?"


" অবশ্যই না। রিত্তিক রোশানের কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। এখন যদি আমি ওকে বিয়ে করি তাহলে তো সবাই ভাববে আমার জন্যই ডিভোর্স হয়েছে। আমি একটা সংসার ভাঙার দায় নিয়ে পাবলিকের গালি খাবো নাকি?"


" ও। এটাও ঠিক।"


সিতারা আবোলতাবোল কথা বলেই যাচ্ছে। ইয়ামিন বাইরে এলো। মিসেস শিমলা অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছেন। ইয়ামিন মোবাইল রিসিভ করেই বলল," হ্যালো মা।"


" কোথায় তুই বাবা?"


" হসপিটালে আছি।"


ইয়ামিন কেন হসপিটালে আছে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে মিসেস শিমলা জিজ্ঞেস করলেন," মেয়েটাকে তোর কেমন লাগল?"


ইয়ামিন চমকে উঠে বলল," কোন মেয়ের কথা বলছো?"


" উষসী।"


" ভালো কিন্তু একটু বেশি রাগী।"


" কি বলছিস? উষসী আর রাগ? অসম্ভব! হতেই পারে না।"


" আমার সঙ্গে তার কথা বলার ধরণটা কেমন রাগী রাগী। কোনো প্রশ্নের সোজা উত্তর দেয় না। গাড়িতে বসে সে কাঁদছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন কাঁদছেন? সে বলল, আমি কাঁদছি এটা আমার ব্যাপার। আপনাকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।"


" ঠিকই তো বলেছে। কাঁদছিল মানে তার মনখারাপ ছিল। ওইসময় তুই প্রশ্ন করতে গিয়েছিস কেন?"


" ও আচ্ছা। তাহলে আমারই ভুল।"


" আমি ঠিক করেছি মেয়েটির সঙ্গে তোর বিয়ে দিবো।"


ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে বলল," কি?"


" যা শুনেছিস ঠিক শুনেছিস।"


" কিন্তু মা, ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে।"


ইয়ামিন এই কথাটা বলে পেছনে ফিরতেই দেখল উষ্ণতা ঝড়ের বেগে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার ভাব-গতিক দেখে মনে হচ্ছে সে এখনি ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরবে। 


মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই আমি এই গল্পটা লেখাও বন্ধ করে দিবো। লেখালেখি আমার দ্বারা হয়তো আর কখনোই সম্ভব না। আমি আর আগের মতো লিখতে পারি না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Smartwatch

Random Products