পঞ্চম পর্ব
Sidratul Muntaz
মিসেস শিমলা আজ ভীষণ ব্যস্ত। তবে তাঁর ঠোঁটে সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে। অনেকদিন পর তার ছেলে দেশে আসছে। তিনি রান্না-বান্নার তোরজোর শুরু করেছেন সেই সকাল থেকে। প্রত্যেক বছর একবার ইয়ামিন বাংলাদেশে আসে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ থেকে আবার ফিরে যায়। এবার নাকি মাসখানেকের জন্য আসবে।
মিসেস শিমলা প্রতি রাতে ছেলের কাছে কাঁদুনী গেয়ে ফিরে আসতে বলেন। ফলশ্রুতিতে ইয়ামিন এবার লম্বা সময়ের জন্য ছুটি নিয়ে আসছে। সে অবশ্য জানে না যে মিসেস শিমলা মনে মনে তার বিয়ের কথা ভাবছেন। জানতে পারলে ভুলেও দেশমুখো হতো না।
উষসী মিসেস শিমলাকে সব কাজে সাহায্য করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মিসেস শিমলার থেকেও দ্বিগুণ খুশি। সে প্রতিটি কথায় হাসছে। সন্দেহবশত মিসেস শিমলা প্রশ্ন করেই ফেললেন,
" আজ তোমার কি হয়েছে বলোতো বেস্টফ্রেন্ড? আমার তো ছেলে আসবে৷ এজন্য আমি খুশি। কিন্তু তুমি এতো খুশি কেন?"
উষসী উত্তরে বলল," জানি না বেস্টফ্রেন্ড। খুশি একটা ছোঁয়াচে রোগ। তাই হয়তো তোমার খুশি আমাকেও ছুঁয়ে ফেলেছে।"
শিমলা খুব জোরে হেসে উঠলেন। এই কয়েকদিনের সম্পর্কে তারা একে-অপরকে বেস্টফ্রেন্ড বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। উষসী মুখে এক উত্তর দিলেও মনে মনে অন্যকথা বলল," আমার জানেমান আসবে৷ এতোদিনের অপেক্ষার পর আমি স্বচক্ষে তাকে দেখবো। আজ আমার চেয়ে বেশি খুশি হওয়ার অধিকার কারো নেই!"
কলিংবেল বাজল। উষসী ছটফটিয়ে উঠল দরজা খুলতে যাওয়ার জন্য। মিসেস শিমলা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন," ওরা মনে হয় চলে এসেছে।"
'ওরা' বলতে ইয়ামিন এবং তার বাবা। উষসী উত্তেজিত কণ্ঠে বলল," তুমি বসো বেস্টফ্রেন্ড। আমি দরজা খুলছি।"
উষসী যাওয়ার আগে বেসিনের আয়নায় নিজের চুল ঠিক করে নিল। মাথায় কাপড় দিতে নিয়েও দিল না। ইয়ামিন আমেরিকা থেকে আসছে। সে নিশ্চয়ই মাথায় কাপড় দেওয়া ধরণের মেয়ে পছন্দ করবে না। উষসী ধুপধাপ করে নিচে নামল। খুশির জোয়ারে হাত কাঁপছে তার। দরজাটাও খুলছে না। উষসী বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল। কিন্তু উত্তেজনায় যেন সে সব ভুলে গেছে। পারুলের মা এসে দরজা খুলে দিলেন। উষসী ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। হৈহৈ করে ঢুকে পড়ল একগাদা ছেলে-মেয়ে। এরা সবাই ইয়ামিনের বাল্যকালের বন্ধু। উষসী সবার মাঝে থেকে ইয়ামিনকে আলাদা করে দেখার আগেই সবাই উপরে উঠে গেল। কেউ যেন তাকে লক্ষ্যই করল না। কিঞ্চিৎ মনখারাপ হলো। মিসেস শিমলা রান্নাঘর থেকে ডাকলেন। উষসী পুনরায় ছুটে গেল।
সেখানে যেতেই সে খেল একটা বড় ধা'ক্কা। মিসেস শিমলাকে রান্নাঘরে এসে জড়িয়ে ধরেছে ইয়ামিন। শিমলা ছেলের বাহুতে মাথা রেখে ঝরঝর করে কাঁদছেন। রান্নাঘরের দরজায় ভীড় জমিয়ে রেখেছে পাঁচ-ছয়জন ছেলে-মেয়ে। তাদের দেখে বড় আফসোস হলো উষসীর। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।
ইয়ামিন তার মাকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের জল মুছে কপালে চু'মু দিচ্ছে। উষসী একদৃষ্টে তাকিয়ে সব দেখছে। তারা চলে যাওয়ার পর পারুলের মা বললেন," আপামণি, শরবতের ডিশটা নিয়া যান।"
" আমাকেই যেতে হবে?" উষসীর প্রশ্নে বিভ্রান্তি। পারুলের মা বললেন," হো। আপনিই যাইবেন। ম্যাডাম বলছে আপনার কাছে দিতে। "
" আচ্ছা দিন।"
উষসীর কেমন লজ্জা লাগছে। সে শরবতের গ্লাস হাতে সবার সামনে গেলে ইয়ামিন আবার তাকে কাজের লোক ভাববে না তো? ধূর, কি আবোল-তাবোল ভাবছে সে! উষসী দরজার কাছে আসতেই শুনল মিসেস শিমলা সবাইকে অনুরোধ করছেন," তোমরা একটু ওকে বোঝাও। আর কত ব্যাচেলর থাকবে? এবার তো ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। ও যদি বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।"
ইয়ামিন কোনো উত্তর দিচ্ছে না৷ তার বন্ধুরা ঠাট্টা-মশকরা করছে।একটি মেয়ে বলল," আন্টি একদম ঠিক বলেছে। তোর এবার বিয়েটা করে নেওয়া উচিৎ দোস্ত।"
ছেলেদের মধ্যে একজন বলল," তুই-ই বিয়েটা করে ফেল না, আরিশা।"
আরিশা বিষম খেয়ে উঠল। সব বন্ধুরা খিকখিক করে হাসতে লাগল। শিমলা অবাক হয়ে বললেন," কি ব্যাপার? তোমরা হাসছো কেন?"
আরিশা নামের মেয়েটি লাজুক কণ্ঠে বলল," কিছু না আন্টি। ওরা এমনিই হাসে।"
উষসী গা জ্বলে যাচ্ছে। ইয়ামিনকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে প্রসঙ্গ তার মোটেও ভালো লাগছে না। সে এই বিষয়ে কিছু শুনতেও আগ্রহী নয়। তাই মনোযোগ মোবাইলে দিয়ে রেখেছে। ব্যাপারটা উষসীকে স্বস্তি দিল। সে শরবতের ডিশ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। মিসেস শিমলা বললেন,
" এইতো, সবার জন্য ওয়েলকাম ড্রিংকস এসে গেছে। "
সবাই উষসীর থেকে শরবত নিল। ইয়ামিনও নিল। তবে উষসীর দিকে তাকালো না। শিমলা ছেলের কাছে এসে বললেন," তোকে আমার বেস্টফ্রেন্ডের কথা বলেছিলাম না? এই হলো সেই মেয়ে। খুব ভালো মেয়ে।আমার পছন্দ।"
মিসেস শিমলা কোন অর্থে পছন্দ বলেছেন তা বুঝতে পারল না কেউ।ইয়ামিন রস-কষহীন উত্তর দিল," ও আচ্ছা।"
আরিশা ভ্রু কুচকে বলল," বেস্টফ্রেন্ড মানে আন্টি? কে এটা?"
" আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। প্রতিবেশী। তোমরা কিন্তু সবাই দুপুরে খেয়ে যেও। আমি আর উষসী মিলে রান্না করেছি।"
আরিশা কৌতুহলী কণ্ঠে জানতে চাইল," ও আপনাকে রান্না-বান্নাতেও হেল্প করে নাকি?"
" সবকিছুতে হেল্প করে। আমি তো সারাদিন বাসায় একাই থাকি। উষসী আমাকে সঙ্গ দেয়।"
দুপুর থেকে উষসীর ফোন আসা শুরু হলো। একবার উষ্ণতা ফোন করছে তো একবার তৃষাণ। উষসী বারবার ফোন কেটে দিচ্ছে। তাকে যদি পরীক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে সে কোনো উত্তর দিতে পারবে না। আজ সে পরীক্ষা দেয়নি। ইয়ামিন আসার খুশিতে কাল সারারাত পড়াশুনাও হয়নি। কি লিখত পরীক্ষার খাতায়? তৃষাণ উষসীকে কলেজ থেকে আনতে গিয়ে নিশ্চয়ই সব জানতে পেরেছে। তৃষাণ জানা মানে উষ্ণতারও জানা। দু'জনই এখন উষসীকে অনবরত ফোন করছে। উষসী মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রাখল।
শিমলা উষসীর হাতে একটি প্লেট দিয়ে বললেন," ইয়ামিনের জন্য বানিয়েছি। ছেলেটা কাস্টার্ড খেতে খুব ভালোবাসে। তুমি নিয়ে দিয়ে আসো।"
উষসীর রা'গ লাগছে। মিসেস শিমলা সব কাজ শুধু তাকে দিয়েই করাতে চাইছেন। সে কি এই বাড়ির কাজের লোক? ইয়ামিন তো সেটাই ভাববে। অবশ্য এতে লাভই হলো। ইয়ামিন তার ঘরে একা। উষসী ঢুকেই কথা বলতে শুরু করল,
" এহেম, এহেম, ভালো আছেন? আপনাকে আমি কি বলে ডাকবো বুঝতে পারছি না। আপনার নিশ্চয়ই আমার কথা মনে নেই। মনে থাকলে চিনতে পারার কথা। কিন্তু আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। অসুবিধা নেই। আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি উষসী। যখন আমাদের শেষবার দেখা হয়েছিল তখন আমার বয়স মাত্র আট। আর আপনি তখন ছিলেন আমার বয়সী। কিছু মনে পড়েছে?"
ইয়ামিন জবাব দিল না। সামান্য হাসল। উষসীর হৃদয়ে বসন্ত বাতাস দোল খেল। এর মানে কি ইয়ামিনের মনে পড়েছে? নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে উষসী কথা এগোতে লাগল,
" আপনি এতোদিন পর দেশে এসেছেন সেজন্য শিমলা আন্টি খুব খুশি। কিন্তু আপনি কি জানেন? আন্টি যে আপনার বিয়ের কথা ভাবছেন? মনে মনে পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছেন। উনি সব কথা আমাকে বলেন। কিন্তু পাত্রীর ব্যাপারে আমাকে এখনও কিছু বলেননি। তবে আমি এইটা জানি যে আপনি এই বিয়েতে রাজি না। সত্যি যদি তাই হয়, তাহলে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। আপনি যদি বলেন, এই বিয়ে কিন্তু আমি এক চুটকিতে ভেস্তে দিবো।"
উষসীকে অনেকক্ষণ ধরে বকবক করতে দেখে ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কান থেকে ইয়ারফোন খুলল। তারপর অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে বলল," আপনি এতোক্ষণ যা যা বলেছেন সব আবার প্রথম থেকে বলুন। আমি আসলে একটা মিটিং-এ ছিলাম। কিছু শুনতে পাইনি।"
উষসীর মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেল। সব কথা আবার প্রথম থেকে বলার কোনো আগ্রহই পেল না। মুখ ভার করে বলল," কিছু বলিনি আমি।"
" আর ইউ শিউর? কিন্তু আমি যে দেখলাম আপনি ঠোঁট নাড়ছেন? নিশ্চয়ই কিছু বলছিলেন!"
" গান গাইছিলাম।" উষসী উত্তরটা দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাগে নিজের মাথায় কয়েকটা চা-পড় দিল। ইয়ামিনের কানে যে ইয়ারফোন লাগানো সেটা একবারও খেয়াল করেনি সে। বোকার মতো বকবক করেই যাচ্ছিল। কোনো মানে হয়? উষসী যখন ঘর থেকে বের হয়েছে তখনি ইয়ামিনের একটা ছেলে বন্ধু ঘরে ঢুকছিল। উষসীকে দেখে সামান্য হাসল সে। হাত নেড়ে 'হায়' বলল। উষসী জবাব দিল না। এই ছেলেটা শুরু থেকেই তার সাথে কথা বলার তালে আছে। নিশ্চয়ই ফ্লার্ট করতে চায়। উষসী চলে যাওয়ার সময় শুনল, ছেলেটি ইয়ামিনকে বলছে," দোস্ত, আরিশাকে এবার প্রপোজটা করেই ফেল। মেয়েটা নয়বছর ধরে তোর জন্য ওয়েট করছে। তাছাড়া তোদের দু'জনেরই বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।"
উষসী পুরো কথা না শুনেই ধুপধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে যেতে লাগল। পারুলের মা উষসীর কান্ড দেখে অবাক হয়ে বললেন," আরে আপামণি, করেন কি? এতো জোরে সিঁড়ি থেকা নামলে তো উষ্টা খাইবেন। ও কি! আপনে কি কানতাছেন?"
" কই? একদম না! অযথা কাঁদতে যাবো কেন? আমার কিছু হয়নি।"
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করছিলেন মিসেয়া শিমলা। ডাইনিং টেবিলে ক্লোথ বিছিয়ে প্লেট সাজাচ্ছেন। উষসী এসে বলল," আমি চলে যাই বেস্টফ্রেন্ড। আমার বাড়ি থেকে ফোন আসছে।"
মিসেস শিমলা চোখ রাঙিয়ে বললেন," অসম্ভব। না খেতে কোথাও যেতে পারবে না তুমি।"
কিন্তু উষসীর আর থাকার ইচ্ছে নেই। ইয়ামিন আর আরিশাকে একসাথে দেখার চেয়ে তার কাছে ম'রে যাওয়া সহজ মনে হচ্ছে। উষসী তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বাড়ি যাবে এবং এই মুহূর্তে যাবে। তাই বাহানা দিয়ে বলল," আমার একটা ফ্রেন্ডের মা অসুস্থ। আমাকে তার বাসায় যেতেই হবে। ইমারজেন্সী।"
" কোথায় তোমার ফ্রেন্ডের বাসা?"
উষসী নিজের বাড়ির ঠিকানাই বলল," ঝিগাতলা।"
" এতোদূর একা যাবে? কোনো দরকার নেই। দাঁড়াও, ইয়ামিনকে বলছি তোমার সঙ্গে যেতে। "
উষসী যারপরনাই বিস্মিত। মিসেস শিমলা ইয়ামিনকে ডেকে পাঠালেন।
চলবে
জানিনা কি হয়েছে আমার। আগের মতো আর লিখতে পারি না। অনুভূতিও আসে না। সবকিছু কেমন হারিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও যেন হারিয়ে যাচ্ছি...